OrdinaryITPostAd

ডেঙ্গু জ্বর

 স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ীচলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ডেঙ্গু  রোগী ১ হাজার ৪৪৭ জনযা গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। এই ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক।



ডেঙ্গু পরিচিতিঃ


ডেঙ্গু জ্বর হলো মশাবাহিত (এডিস মশা) ডেঙ্গুর জীবাণু দ্বারা সংঘটিত একটি রোগ। ডেঙ্গু জ্বর(সমার্থক ভিন্ন বানান ডেঙ্গি) ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ সালে, যখন এই রোগের কারণে সৃষ্ট মহামারির কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা। ১৯০৬ সালে এডিস মশা যে ডেঙ্গুর বাহক, তা নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা
১৯৭০ সালের পর এটি শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রায় ৯০ শতাংশ হয়ে থাকে অনূর্ধ্ব–১৫ বছর বয়সে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে। এর মধ্যে প্রায় ৯৬ মিলিয়ন অসুস্থ হয়, ৫ লাখ লোক হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং প্রতিবছর এর কারণে সাড়ে ১২ থেকে ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। ট্রপিক্যাল রোগ হিসেবে ম্যালেরিয়ার পরই ডেঙ্গুর স্থান। ১৯৬০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে ২০০১-০২ সালে প্রথমবার বিস্তৃতভাবে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ এ ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

সূচিপত্রঃ

>
এডিস মশা
> ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গ গুলো
> ডেঙ্গু জ্বরের ধারাবাহিকতা
> ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
> ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জন্য ডায়েট
> ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকার
> প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম
> পরিশেষে



এডিস মশাঃ

এডিস এক প্রকার মশা। যেটি ডেঙ্গু ও পীতজ্বরের মতো মারাত্মক দুটি রোগের বাহক। কয়েক প্রজাতির স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণুর বাহক, যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি প্রধান। এই স্ত্রী মশা যখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পান করে, তখন ডেঙ্গুর জীবাণু ওই মশার দেহে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে লালাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। পরে এই মশা যখন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তির ত্বকের মাধ্যমে ডেঙ্গুর জীবাণু তার দেহে প্রবেশ করে।

আরও পড়ুনঃ 

১৯টি জায়গায় এডিস মশা বেশি বসবাস করে থাকে বলে জানিয়েছেন ভি নাগপাল নামক একজন কৃটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞ। এগুলো হলো- পুরনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের ব্লক, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ফোকর ও বাঁশ, দেয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরনো জুতা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, ছাদে, অঙ্কুরোদগম উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত ও অপরিচ্ছন্ন সুইমিং পুলে এডিস মশা জন্ম নেয়।


ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গ গুলো হলো - 

  • প্রচণ্ড পেট ব্যথা
  • ক্রমাগত বমি হওয়া
  • মারি বা নাক থেকে রক্তপাত
  • প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত
  • অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা 
  • ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে)
  • দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস
  • ক্লান্তি
  • বিরক্তি এবং অস্থিরতা


ডেঙ্গু জ্বর এর ধারাবাহিকতাঃ

ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে (সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন) রোগের উপসর্গ দেখা যায় ডেঙ্গু উপসর্গের বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা(সাধারণতঃ দু’চোখের মাঝে), মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, এবং র‍্যাশ বেরোনো। ডেঙ্গুর আরেক নাম “হাড়-ভাঙা জ্বর” যা এই মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে। মেরুদণ্ড ও কোমরে ব্যথা হওয়া এ রোগের বিশেষ লক্ষণ। প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ্বর, প্রায়শ ৪০ °সে (১০৪ °ফা)-র বেশি, সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথা ও মাথাব্যথা; এটি সাধারণতঃ দুই থেকে সাতদিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে ৫০-৮০% উপসর্গে র‍্যাশ বেরোয়। 
এটা উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে লাল ফুসকুঁড়ি হিসাবে দেখা দেয়, অথবা পরে অসুখের মধ্যে (দিন ৪-৭) হামের মত র‍্যাশ দেখা দেয়। কারোর মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে। কিছু লোকের ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার কারণে প্রবল জ্বর হয় এবং সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে তরল বুক এবং অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে বর্ধিত ক্যাপিলারি শোষণ ও লিকেজের কারণে জমে। এর ফলে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়।

এরপর আরোগ্য পর্যায়ে বেরিয়ে যাওয়া তরল রক্তপ্রবাহে ফেরত আসে। এটি সাধারণত দুই থেকে তিনদিন স্থায়ী হয়।এই উন্নতি হয় চমকে দেবার মত, কিন্তু এতে প্রচণ্ড চুলকানি এবং হৃদস্পন্দনের গতি ধীরহতে পারে। আরেকরকম র‍্যাশও বেরোতে পারে ম্যাকুলোপাপুলার বা ভাস্কুলাইটিক রূপে, যার ফলে ত্বকে গুটি বেরোয়। এই পর্যায়ে তরলের অতিপ্রবাহ অবস্থা ঘটতে পারে। যদি এতে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় তাহলে সচেতনতার মাত্রা হ্রাস অথবা মূর্ছা যাওয়া হতে পারে। এর পর এক ক্লান্তির অনুভূতি অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।


ডেঙ্গু জ্বর এর চিকিৎসাঃ

ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিশেষ কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘরোয়া চিকিৎসাতেই কমে যায়। চিকিৎসকরা পেরাসিটামিল জাতীয় ওষুধ দিয়ে যন্ত্রণা এবং জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। অ্যাসপিরিন বা এ-জাতীয় ওষুধ কখনোই জ্বর নিবারণে ব্যবহার করা যাবে না। এতে রক্তপাতের আশঙ্কা বাড়ে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে, বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান করতে হবে।

 দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সাধারণ ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। প্রায় ৮৫ শতাংশ ডেঙ্গুজ্বর থাকে সাধারণ মাত্রার, বাড়িতে যার চিকিৎসা করানো সম্ভব।



ডেঙ্গু জ্বর এর রোগীদের জন্য ডায়েটঃ


বিশেষজ্ঞদের মতে
, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তকালীন সময় ডায়েটে প্রোটিন, প্রোবায়োটিক ও আয়রনযুক্ত খাবার থাকা জরুরি।
দুধ, দই ও দুগ্ধজাত খাবার প্রোবায়োটিকসের সমৃদ্ধ উৎস। দইয়ে থাকা ল্যাকটোব্যাসিলাস নামক ব্যাকটেরিয়া আমাদের অন্ত্রের উপকার করে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দুগ্ধজাত খাবার শরীরে পটাশিয়াম, ফসফরাস ও সোডিয়ামের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে

Ø  প্রোটিনজাতীয় খাবার তাড়াতাড়ি রোগ সারাতে মুখ্য ভূমিকা নেয়। তাই এই সময় খাবারে মাছ, মাংস, ডাল, ডিম, বাদাম ইত্যাদি থাকা একান্ত জরুরি।

Ø  প্লেটলেটের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে পরিচিত হল পেঁপেঁপাতার রস। তেতো লাগলেও এই রস ডেঙ্গির মোকাবিলায় ভীষণ উপকারী।

Ø  জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে তরল খাবার খাওয়া তুলনায় সহজ। তাই এই সময় শক্ত খাবারের পরিবর্তে তরল খাবার যেমন মাংসের স্যুপ,দইয়ের লস্যি ইত্যাদি খাওয়ানো উচিত। এক্ষেত্রে খাবার দু-আড়াই ঘন্টা অন্তর পরিবেশন করা ভালো।

Ø  সবুজ শাকসবজি ভিটামিন কে ও আই-এর সমৃদ্ধ উৎস। এই দুটি ভিটামিনই রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন। পার্সলে পাতা, পালং শাক, পুদিনা, বাধাকপি, শতমূলী ইত্যাদি রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে।

Ø  ভিটামিন সি ও ফোলেটও প্লেটলেটের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। কমলালেবু, পাতিলেবু, জলপাই, আনারস, বেরি ও কিউই ফল এই ভিটামিনের সমৃদ্ধ উৎস।

Ø  ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসক কুমড়ো খাওয়ার পরামর্শ দেন। কুমড়ো ভিটামিন এ-এর সমৃদ্ধ উৎস যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

ডায়েটে যেমন কিছু খাবার না রাখলে নয়
, তেমনই কিছু খাবার এই সময় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

Ø  আমিষ খাবার

Ø  চর্বি

Ø  তৈলাক্ত খাবার

Ø  ভাজাভুজি বা মসলাযুক্ত খাবার

ডেঙ্গু জ্বর এর প্রতিকারঃ

১. পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।

২. প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের                      জুস এবং খাবার স্যালাইন পান করুন একটু পরপর।

৩. ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি–সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৪. ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন–জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ–জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

প্রতিকার এর চেয়ে প্রতিরোধ উত্তমঃ

কয়েকটি দেশে ট্রায়াল হিসেবে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিষেধক টিকা ব্যবহার করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো স্বীকৃত টিকা বাজারে আসেনি।  যেহেতু এখনো কোনো প্রতিষেধক নেই, কোনো অ্যান্টিভাইরালও কার্যকর নয়, তাই বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো ট্রপিক্যাল অঞ্চলে বসবাসরত বা ভ্রমণরত ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীকে এডিস মশার কামড় থেকে সুরক্ষা দেওয়া। এ ব্যাপারে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ বেশি জরুরি। যেমন:

Ø  ঘিঞ্জি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় না থাকার চেষ্টা করুন

Ø  বাড়িতে মশারি, মশা তাড়ানোর ঔষধ ব্যবহার করুন

Ø  বাইরে যাওয়ার সময় ফুলহাতা জামা ব্যবহার করুন

Ø  মোজা পরুন

Ø  জানালায় নেট লাগান অথবা দরজা জানালা বন্ধ করে রাখুন

Ø  এয়ারকন্ডিশন থাকলে ব্যবহার করুন

Ø  ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকলে ডাক্তার দেখান

Ø  দিনের বেলা ও সন্ধ্যার সময় ডেঙ্গু মশা কামড়ায় সেইসময় সতর্ক থাকুন


পরিশেষেঃ


ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে।
সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন। প্রয়োজনে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url