হযরত খাদিজা (রা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
খাদিজা (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথম স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা (রাঃ) এর জন্ম হয় ‘আমুল ফীল’ এর ১৫ বছর পূর্বে ৫৫৬ সনে মক্কা নগরীতে।
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নবুয়ত প্রকাশের ৫৫ বছর আগে পবিত্র নগরী মক্কায়। পিতা
ছিলেন খুয়াইলিদ বিন আসাদ ও মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে যায়েদ।
হযরত খাদিজা (রাঃ) মক্কার কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু মা হযরত খাদিজা (রাঃ) খুবই সাধারন জীবনযাপনে
অভ্যস্ত ছিলেন। খাদিজা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। ইসলাম ধর্ম আসার আগে তিনি হযরত
ইব্রাহিম আঃ এর ধর্ম পালন করতেন। তখন আরবে হযরত খাদিজা (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত
দানশীল। দান করার ক্ষেত্রে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। খাদিজা রাঃ ছিলেন হিজাজের অনেক
বড় মাপের একজন মহিলা ব্যবসায়ী। হযরত খাদিজা (রাঃ) আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করতেন এবং
তাঁর এটার প্রতি অনেক বেশি ঝোঁক ছিল।
রাসুল (সাঃ) এর সাথে বিবাহ হওয়ার পূর্বে তিনি এক আশ্চর্যজনক
স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের কথা তার চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফলের কাছে বর্ণনা
করেন। তার স্বপ্নটি ছিল এ রকম যে, আকাশ হতে আমার কোলে একটি চাঁদ নেমে আসল এবং
সেটা আবার সাত ভাগে বিভক্ত হল। ওরাকা বিন নওফেল বলল: এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা হল শেষ
যুগে এক রাসূলের আবির্ভাব ঘটবে এবং তার সাথে তোমার বিবাহ হবে। আর সেই বিবাহের ফলে
তোমাদের থেকে সাতটি সন্তান জন্ম নিবে।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একদিন আসবেন এবং
তিনি আমাদের নবীজি সাঃ জন্য অপেক্ষা করতেন। তাই তিনি মাঝে মধ্যে আরবের সবচেয়ে বড়
বড় ধর্মযাজকদের নবীজির আগমনের বা নবীজির আগমনের নিদর্শন সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
হয়তো হযরত খাদিজা (রাঃ) এই আগ্রহের জন্যই মহান আল্লাহ্
রাব্বুল আলামিন রাসুল সাঃ এর নবুয়াতের আগেই খাদিজা রাঃ সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেন এবং
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠান।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ব্যবসার কাজে মক্কা থেকে শামে
(সিরিয়া) গিয়েছিলেন, তখন খাদিজা (রাঃ) সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এবং
তাঁর সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ শুরু করেন। খাদিজা (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর
আখলাক ও চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর স্বপ্নের সাথে সব মিলে যাচ্ছিল।
আমাদের নবীজির সাঃ এর উত্তম গুণাবলী এবং তাঁর আমানতদারিতা খাদিজার রাঃ কাজে অনেক
ভালো লাগে। মা খাদিজা বুঝতে পারেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ হচ্ছেন আরবের মধ্যে সবচেয়ে
উত্তম ও সৎ একজন পুরুষ।
তিনি আরও বুঝতে পারেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সমাজের সুবিধা
বঞ্চিতদের অধিকারের ক্ষেত্রে খুবই সচেষ্ট। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এইসব গুণাবলীর জন্য
খাদিজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) কে ডাকলেন
এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই প্রস্তাবে একটু
চিন্তিত হলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), খাদিজা (রাঃ) এর
প্রস্তাবের কথা তাঁর চাচা আবু তালেবকে বললেন। চাচা আবু তালেব এই প্রস্তাবের কথা
শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং চাচা আবু তালিব সবকিছু বিবেচনা করে হযরত মুহাম্মদ
(সাঃ) এর সম্মতি নিয়ে বিবাহে রাজি হন। হযরত খাদিজা ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিয়ে
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন।
খাদিজা (রাঃ) নিবিড় ভালবাসাকে মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) উপলব্ধি করেছিলেন,এমন সময় আকাশ থেকে শব্দ এলো ও বলল:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ
পবিত্র নারীকে পবিত্র ও সত্যবাদী স্বামী দান করে থাকেন।”
তখন তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা সড়ে যায় এবং বেহেস্তের
হুরগুলো যে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল তা অবলোকন হয় এবং আতরের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে
পড়ে আর সবাই বলতে থাকে যে, এত সুন্দর সুগন্ধ এই সততা থেকেই উৎসারিত হয়েছে।
রাসুলের (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে বিবাহ ১০ রবিউল আউয়াল নবুয়ত ঘোষণার
১১ বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং খাদিজা রাঃ বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবনের যাত্রা শুরু করেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স
তখন ছিল ২৫ এবং খাদিজা রাঃ বয়স ছিল তখন ৪০।
কিন্তু তখনকার আরব সমাজ এই বিয়েটা সহজভাবে নিতে পারে
নাই।কারন সেই অন্ধকার যুগে সবকিছু মাপা হতো ধনসম্পত্তির উপর ভিত্তি করে। কিন্তু
আমাদের নবীজির অর্থ সম্পদ কিছুই ছিল না। অপরদিকে মা খাদিজার অঢেল সম্পত্তি ছিল।
তাই সমাজে সবাই নাক ছিটকাতে থাকে।অনেকেই বিবি খাদিজা বলতে থাকে তুমি কেন এত দরিদ্র
একটি ছেলেকে বিয়ে করতে গেলে।
বিবি খাদিজা রাঃ এর উত্তরে বলতেন,
“এই সমাজে মুহাম্মদ
(সাঃ)-র মতো আর কেউ কি আছে? তার মতো সচ্চরিত্রবান ও মর্যাদাবান দ্বিতীয় কোন
ব্যক্তিকে কি তোমরা চেন? আমি তার সৎ গুণাবলীর কারণেতাকে বিয়ে করেছি।”
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে
বিবাহের পূর্বে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর আরও দুটি বিবাহ হয়েছিল। প্রথম স্বামীর ঔরসে
একটি পুত্র ও দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। হযরত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বিবাহের পর প্রথম পাঁচ বছর
পর্যন্ত তাঁর কোন সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করেনি। বিবাহের পাঁচ বছর পর হযরত মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঔরসে হযরত খাদীজার (রাঃ)-এর গর্ভে একাধিক্রমে
চারটি কন্যা ও দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁর প্রথম একটি পুত্র সন্তান
জন্মগ্রহণ করে। পুত্রটির নাম রাখা হয় কাসিম । এ পুত্রটি শিশুকালেই মৃত্যুমুখে
পতিত হয়। দ্বিতীয়বারে হযরত খাদীজার গর্ভে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
কন্যাটির নাম রাখা হয় জয়নব। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুইজন
শাহজাদা কাসিম, আবদুল্লাহ যাদের উপনাম তাহির ও তায়্যেব। এবং চারজন কন্যা
সন্তান রুকাইয়াহ, জয়নাব , উম্মে কুলসুম, ফাতিমা
(রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম) এর জননী ছিলেন আম্মজান খাদিজা (রাঃ)।
রাসুল সাঃ এর সাথে বিয়ে হলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিবিখাদিজা রাঃ কে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন এইটা খাদিজা জানতেন।
কিন্তু তখনকার সমাজ বিবি খাদিজার এই যুক্তি বুঝেনি। আর তাই
আরবের অনেকেই বিবি খাদিজার সাথে শত্রুতা শুরু করে দেয়। আর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর
নবুয়াতের পর এই শত্রুতা আরও বেড়ে যায়। বিবি খাদিজার প্রতি শত্রুতার এতো পরিমাণেই
বেড়ে যায় যে, তিনি যখন সন্তান প্রসব করেন কেউ তাকে সাহায্য করে নাই। মোট
কথা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে বিয়ে করার কারনে তিনি তখনকার সমাজ থেকে একেবারে
বিছিন্ন হয়ে পড়েন।কিন্তু মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন খাদিজার রাঃ একাকীত্ব দূর
করে দেন। এবং তাঁর সন্তান প্রসবের সময় মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত
মহিলাদের পাঠিয়েছিলেন তাকে সাহায্য করার জন্য।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহের
সময় হযরত খাদীজার বয়স ছিল চল্লিশ বছর এবং হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঁচিশ বছর। বিবাহের পনের বছর পরে অর্থাৎ হযরত রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলে তিনি নবুয়ত লাভ
করেন। বিবাহের পর হতে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত
লাভের পূর্ব পর্যন্ত পনের বছর; আরব দেশের সেই অন্ধকার যুগেও তাঁদের দাম্পত্য
প্রেম দর্শন করে প্রত্যেক দম্পতির মনে হিংসার উদ্রেক হত। প্রাক্-ইসলামিক যুগে আরব
দেশে দাম্পত্য প্রেমের কোনই মূল্য ছিল না। তথায় বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। কোন
পুরুষ একটি বিবাহ করে দু'চার-দিন পরেই তাকে পরিত্যাগ করে আর একটি বিবাহ
করত ।
এভাবে কারও স্ত্রীর সংখ্যা শয়ের কোঠায় গিয়ে পৌঁছত।
তখনকার দিনে স্ত্রীর মতামতের কোন মূল্য ছিল না। দাম্পত্য-প্রেম বলেও কোন কিছুর
অস্তিত্ব ছিল না। অথচ সে যুগেও হযরত রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের সাথে হযরত খাদীজার (রাঃ) দাম্পত্য প্রেমের যে নিদর্শন রয়েছে তা সত্যিই
অপূর্ব। বিবাহের অল্পকাল পরেই হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর অতুল ঐশ্বর্য স্বামীর চরণে
ঢেলে দিয়ে তাঁর আনুগত্য প্রকাশই জীবনের একমাত্র শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত খাদীজা (রাঃ) একেতো ছিলেন বিধবা, তদুপরি তাঁর বয়সও
ছিল হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়েও অনেক বেশি, এরূপ স্থলে
স্বামী-স্ত্রীর পূর্ণ মনের মিল হওয়াটা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে উঠে ৷ অথচ তাদের
দাম্পত্য জীবন এত প্রেমময় ও মধুর হয়েছিল যে, হযরত খাদীজা
(রাঃ)বর্তমান থাকা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য
কোন স্ত্রী গ্রহণের কথা কোনদিন কল্পনাও করেননি। হযরত খাদীজার (রাঃ) ইন্তেকালের পর
বহুদিন পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে কোন কথা বলতেই তিনি কেঁদে ফেলতেন।
নবুয়ত লাভের পরেও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম অধিকাংশ সময় হেরা গুহায় বসে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন বলে হযরত খাদীজা
(রাঃ) একসঙ্গে কয়েকদিনের খাদ্য পানীয় তাঁর সংগে দিয়ে দিতেন। তা শেষ হয়ে গেলে
তিনি পুনরায় বাড়ি এসে খাদ্য ও পানীয় নিয়ে যেতেন। কোন কোন সময় তাঁর আসতে
বিলম্ব দেখলে হযরত খাদীজা (রাঃ) নিজেই গিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামকে খাদ্য দিয়ে আসতেন। একদিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে বসে আছেন এমন সময় সেখানে জিব্রাইল (আঃ)
ফেরেস্তা আগমন করে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম, হযরত খাদীজা আপনার জন্য খাদ্য ও পানীয় নিয়ে আসছেন। আপনি
তাঁকে আমার ছালাম জানিয়ে বলবেন, আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর জন্য
মণি-মুক্তাখচিত একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন ।
হযরত আমীর হামজা (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমি
খানায়ে কা'বার নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম যে, মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ধূলিমাখা
শরীরে বিষণ্ণ বদনে কা'বাগৃহে বসে আছেন। তা দেখে আমি তাঁর দিকেই
অগ্রসর হচ্ছি ঠিক এমনি সময় খাদীজা (রাঃ) দ্রুতবেগে আমার নিকট দিয়ে দৌড়িয়ে কা'বাগৃহে প্রবেশ
করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয় ধরে ক্রন্দন করতে লাগলেন
এবং নিজের ওড়না দ্বারা তাঁর শরীরের ধুলা-বালি মুছে দিয়ে খেজুর পাতা দ্বারা বাতাস
করতে লাগলেন। তৎপরে তাঁকে একটু সুস্থ করে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। মহাত্মা আফিক
আফেন্দী (রাঃ) বলেছেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে একবার মক্কায়
গিয়ে হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করে সেখানেই আহারাদি ও রাত্রিযাপন
করলাম। পরদিন সকালে আমি দেখতে পেলাম, একজন যুবক কা'বাগৃহের সামনে
এসে কেবলামুখী হয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পরেই একটি বালক এসে
তাঁর পাশে দাঁড়াল, আরও একটু পরে একজন স্ত্রীলোক এসে তাঁর পিছনে
দাঁড়াল। তাঁরা তিনজন সেখানে নামায পড়ে চলে যাবার পরে হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে বললাম, দুনিয়ার একটা
বিরাট পরিবর্তনের সময় এসে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তদুত্তরে হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, যে যুবক সকলের
সামনে বামদিকে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আমার ভাতিজা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম । আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তাঁর পাশে যে দাঁড়িয়েছিল, সে বালকটিও আমার
ভাতিজা আবু তালিবের পুত্র আলী (রাঃ)। আর তাঁদের পিছনে যে স্ত্রীলোকটি দাঁড়িয়েছিল
সে আমার ভাতিজা-বধূ মুহাম্মদের স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)। যদিও হযরত খাদীজা (রাঃ) জীবিত
থাকতে কাবাগৃহে প্রকাশ্যভাবে কেউ নামায পড়তে পারেনি, তথাপি স্বামীর
সুখ-দুঃখের সমভাগিনী হযরত খাদীজা অনেকদিন পর্যন্ত স্বামীর সাথে গভীর রাতে খানায়ে
কাবায় এসে গোপনে নামায পড়তেন ।
যখন আরবের প্রত্যেকটি মানুষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ঘোর শত্রুতা করেছিল, যখন হযরত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বংশের লোকেরাও তাঁর
প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করেছিল, যখন তাঁর পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন
কেউই তাঁর স্বপক্ষে ছিল। না। সেই ঘোর দুর্দিনে তিনি নিজের ধন-সম্পত্তি ও জীবন-মন
স্বামীর চরণে উৎসর্গ করে স্বামী সেবাকেই জীবনের একমাত্র কর্তব্য বলে গ্রহণ
করেছিলেন। হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর তখনকার সক্রিয় সহযোগিতাই যে জীবন সংগ্রামে তাঁকে
জয়ী করেছিল, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই
মুক্ত কণ্ঠে একথা স্বীকার করেছেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের সেই কঠিন বিপদের সময় হযরত খাদীজা (রাঃ) সর্বদা ছায়ার ন্যায় তাঁর
সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী হয়ে সত্যধর্ম প্রচারে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিলেন। একদিকে
তাঁর অতুলনীয় স্বামী ভক্তি, সেবা-শুশ্রূষা ও সান্ত্বনা বাক্য হযরত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথা-জর্জরিত প্রাণে সুশীতল
শান্তিবারি সেচ করত, অন্যদিকে তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনাপূর্ণ উপদেশ
তাঁকে কর্তব্যের পথে এগিয়ে দিত।
কাফেররা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে একঘরে করে একাধিক্রমে তিন বছর মক্কার নিকটবর্তী পর্বত গুহায় নজরবন্দী
করে রেখেছিল। তখনও হযরত খাদীজা (রাঃ) ছিলেন তাঁর সুখ-দুঃখের সমভাগিনী। এ তিনটি বছর
যে তাঁদের কত দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা
অসম্ভব। দিনের পর দিন অনাহারে অনিদ্রায় কাটাতে হয়েছে। হযরত খাদীজা (রাঃ) ইচ্ছা
করলে অতি সহজেই এসব দুঃখ-কষ্টের ও বিপদের ঝুঁকি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারতেন।
কিন্তু তিনি তা না করে স্বেচ্ছায়ই এসব দুঃখ-কষ্ট মাথা পেতে নিয়েছিলেন। একজন আদর্শ
পতিব্রতা মুসলিম রমণীর মধ্যে যতগুলো গুণ থাকা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটিই হযরত
খাদীজা (রাঃ)-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। একাধারে এত অধিক গুণবতী রমণী দুনিয়ার
ইতিহাসে আর একজনও দেখা যায় না। ধনীর গৃহের আদরের দুলালী ছিলেন তিনি। হযরত
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহ হওয়ার পূর্বে আরও দু'বার যাদের সঙ্গে
তাঁর বিয়ে হয়েছিল তারাও ছিলেন বিত্তশালী বা বড়লোক।তাদের অন্য কোন ওয়ারিশ না
থাকায় তাদের যাবতীয় সম্পদ তিনিই লাভ করেছিলেন। তাছাড়া নিজেও ব্যবসা বাণিজ্য করে
প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। কাজেই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের সাথে বিবাহ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জীবনে একটি দিনের জন্যও দুঃখ-কষ্ট বা
অভাব অভিযোগ কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। অথচ সেই খাদীজা শুধু স্বামীর জন্যই নিজের
যাবতীয় ধন-দৌলত লুটিয়ে দিয়ে, সকল সুখ-শান্তি ও আয়েশ আরামের আশা বিসর্জন
দিয়ে স্বামীর দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও কোনদিন তাঁর মুখে বিন্দুমাত্র বিষাদের
চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি জীবনে একটি মুহূর্তের জন্যও স্বামীর প্রতি এতটুকু
অসন্তুষ্ট বা অবজ্ঞা প্রকাশ করেননি। অথবা সেবা-যত্নের কোন ত্রুটি বা শৈথিল্য
প্রদর্শন করেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন, হযরত ! আমার
যাবতীয় ধন-দৌলত আপনারই। আমার নিজস্ব বলতে আমি শুধু আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কিছু রাখতে চাই না। আমার ধন-দৌলত
আপনি যেভাবে ইচ্ছা করেন, যে কাজে প্রয়োজন বোধ করেন, সে ভাবেই সে কাজেই
খরচ করবেন; তাতে আমার বলার কিছুই নেই। আমার শুধু একমাত্র প্রার্থনা যে, আমাকে সর্বদা
আপনার দাসী বলে স্মরণ রাখবেন ও সেবার সুযোগ দান করবেন।
হযরত খাদীজার এসব ত্যাগের কথা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে কোনদিনই ভুলে যান নি। তিনি প্রায়ই বলতেন, সর্ব প্রথম
খাদীজার ধন-দৌলত, তৎপর আবু বকরের ধন-দৌলত দ্বারা ইসলামের যে
বিদমত হয়েছে সেরূপ আর কারও দ্বারাই হয়নি। হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর প্রতি হযরত
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসা কত গভীর ছিল হযরত আয়েশা
(রাঃ) সিদ্দিকার বর্ণনা হতেও তা অনেকটা বুঝতে পারা যায়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা
(রাঃ) বলেছেন, হযরত রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে
পুনঃ পুনঃ হযরত খাদীজার প্রশংসা শুনে কখনও কখনও আমি হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের উপর বিরক্ত হতাম। আমি । হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে বলতাম, খাদীজা ভিন্ন আপনি কি অন্য কোন স্ত্রীলোক
দেখেননি যে সব সময় তার কথাই বলেন ? আমার এ কথার
উত্তরে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, হ্যাঁ, খাদীজার তুলনা
শুধু খাদীজাই ছিল ।
সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়াতের দশম বর্ষে ইসলাম গগণের দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র
কক্ষচ্যুত হয়ে গেল- (১) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
চাচা আবু তালিবের মৃত্যু ও (২) হযরত খাদীজার (রাঃ) মহাপ্রয়াণ। এজন্য সে বছরটিকে
বলা হতো আমোল হুজন অর্থাৎ শোকের বছর। আবু তালিব ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রধান
সাহায্যকারী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলমানদের যেন একেবারে পাজর ভেঙে গেল । আর হযরত
খাদীজা (রাঃ) তো ছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
দক্ষিণ হস্ত। এ দুজনের ইন্তেকালে হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম শোকে একেবারে মূহ্যমান হয়ে পড়লেন।
খাদিজা রাঃ অনেক আরাম আয়েশে বড় হয়েছিলেন। কিন্তু যখন ইসলাম
ধর্ম গ্রহণের জন্য মুসলমানরা অবরোধের স্বীকার হন তখন বিবি খাদিজা রাঃ অনেক অনেক
কষ্ট স্বীকার করেছিলেন হাসিমুখে। নিজের সব ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলাম
প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু কখনো তিনি তাঁর কষ্ট প্রকাশ করেন নাই। ইসলামের জন্য তাঁর
প্রিয় স্বামী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জন্য সব কিছু তিনি সহ্য করেছিলেন। শোয়াবে আবু
তালিব নামক উপত্যকায় অবরুদ্ধ থাকার কারনে তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পরেন। বিবি খাদিজা
রাঃ স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙ্গে যায় এবং তিনি মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান।
মৃত্যুর সময় খাদিজা রাঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে উদ্দেশ্য
করে বলেছিলেন,
“হে রাসূল আমি
আপনার সব অধিকার পরিপূর্ণ ভাবে রক্ষা করতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করে
দিন।”
দশম হিজরীর ১০ রমযান, ইংরেজী ৫১৯
খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি তারিখ, ৬৫ বছর বয়সে
উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজা (রাঃ) জগতের প্রতিটি মুসলমান নর-নারীকে শোক সাগরে
ভাসিয়ে ইহজগত হতে চির বিদায় গ্রহণ করলেন।
(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)
হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
হৃদয়ে শোকের ঝড় প্রবাহিত হল । মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে এ দুঃসংবাদ ছড়িয়ে
পড়ল । সমগ্র আরব জগৎ বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল ।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র পাগড়ীর দ্বারা হযরত খাদীজার পবিত্র দেহ আচ্ছাদিত করে জান্নাতুল মুয়াল্লা নামক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হল। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বহস্তে তাঁকে কবরে নামিয়েছিলেন। হযরত খাদীজার ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জানাজার নামায পড়ার আদেশ ছিল না বলে দাফন করার পর হযরত রাসূলুল্লাহর সাথে অগণিত লোক হাত উঠিয়ে হযরত খাদীজার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url