বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস (১০ সেপ্টেম্বর)
বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস
‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো’- প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ১ হাজার মৃত্যুর মধ্যে ১৩ জনই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আবার প্রতি ১০০টি আত্মহত্যা ঘটানো মানুষের মধ্যে ৫৮ জনের বয়সই ৫০ বছরের নিচে। এরও প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
একটি আত্মহত্যার ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তির হারিয়ে যাওয়া নয়, তার চারপাশের প্রিয়জনের জন্যও অসহনীয় বেদনার। অনেক স্বপ্নের মৃত্যু, একজনের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকের জীবনের গতির আকস্মিক পরিবর্তন। বিশ্বজুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটাতে পারেন যেকোনো বয়সের নারী বা পুরুষ। যাঁদের বিষণ্ণতা রোগ রয়েছে, অন্যদের চেয়ে তাঁরা ২০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ, আবার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা করার হার দ্বিগুণ। বেশির ভাগ আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। এ বয়সী কিছু পুরুষও নানা কারণে আত্মহনন করে। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে দেশে আত্মহননের ঘটনা সাড়ে ৬ হাজারের বেশি। সংখ্যাটি উদ্বেগজনক।
বিষণ্ণতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা না করলে এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আত্মহত্যা সাধারণত দুই ধরনের—একটি হচ্ছে পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা (ডিসিসিভ), আরেকটি হঠাৎ করে ফেলা আত্মহত্যা (ইমপালসিভ)।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। বিষণ্ণতার রোগীদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র আশাহীনতা তৈরি হয়। তারা মনে করে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এ চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য
আত্মহত্যা ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাগ্রত করতে হবে সুস্থ মানবিক মূল্যবোধ। হতাশাগ্রস্ত মানুষকে তাদের জীবনের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
অপরাধ, সমাজ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সংঘটিত আত্মহত্যার ঘটনাগুলোতে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হলেও জোরালো ও সুষ্ঠু তদন্ত হয় না বললেই চলে। আত্মহত্যার ঘটনার জোরালো ও সুষ্ঠু তদন্ত হলে এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ বেরিয়ে আসতে পারে।
এতে অপরাধী বা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতা থাকলে আত্মহত্যার ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার আগে আত্মহত্যাপ্রবণ লোকদের শনাক্ত করতে হবে। যাঁরা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আগে থেকে বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। আশপাশের কাছের মানুষেরা এই ইঙ্গিতগুলো খেয়াল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে অনেক আত্মহত্যাই প্রতিরোধ করা যায়। ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’ (ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন)। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। আর কাজটি হচ্ছে, আশপাশের কারও মধ্যে আত্মহত্যা করার ইঙ্গিত পেলে তাঁকে দ্রুত সাহায্য করা, তাঁর পাশে থাকা।
যাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, তাঁরা যেসব ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন—
১। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন, কথায় কথায় আড্ডায় মরে যাওয়ার কথা বলেন।
২। সম্প্রতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন বা নিকটজনের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে, যা তিনি মেনে নিতে পারছেন না।
৩। ঘুমের পরিবর্তন হচ্ছে—সারা রাত জেগে থাকছেন।
৪। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন, হঠাৎ রেগে যাচ্ছেন।
৫। আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা ও গান লিখতে, শুনতে বা পড়তে থাকেন।
৬। নিজের ক্ষতি করেন। প্রায়ই তাঁরা নিজের হাত-পা কাটেন, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খান।
৭। মনমরা হয়ে থাকা, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী ভাবা—এগুলো বিষণ্নতার লক্ষণ; যা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
৮। মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি।
৯। নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া।
১০। পড়ালেখা, খেলাধুলা, শখের বিষয় থেকে নিজে দূরে থাকা।
এ ধরনের ইঙ্গিত কারও মধ্যে থাকলে তাঁকে মনঃসামাজিক সহায়তা দিতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ যদি মৃত্যুর কথা বলেন, তখন সবাই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। একটি বড় ভুল ধারণা আছে—যাঁরা মৃত্যুর কথা বলেন, তাঁরা আত্মহত্যা করেন না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তাঁদের মধ্যেই আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই প্রতিটি মৃত্যুর ইচ্ছাকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিতে হবে। মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, কীটনাশক বা বিষ, বিষাক্ত পদার্থ ইত্যাদি দূরে রাখতে হবে। এছাড়া গণমাধ্যমে আত্মহত্যাবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরেই তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করে আসছে আঁচল ফাউন্ডেশন। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সংগঠনটি শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এতে জানানো হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ওই আট মাসে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪ শতাংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা-প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
আত্মহত্যার সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ক বহুকাল ধরেই রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যদি আত্মহত্যার তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মহিলারা আত্মহত্যার পথ বেশি বেছে নেয়। কিন্তু আত্মহত্যার কারণে মৃত্যু বেশি হয় পুরুষদের ক্ষেত্রে। কারণ পুরুষরা আত্মহত্যার যে পথ বেছে নেয়, সেগুলো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং এতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেক বেশি। আমাদের দেশে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার করার সংখ্যাটা বেশি। বিদেশে বেশিরভাগ মানুষ ‘গান শট’ বেছে নেন। এই উপায়ে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। কিন্তু মহিলারা সাধারণত কোনও পিল বা ট্যাবলেটের সাহায্য নেয়। কয়েক বছর আগেও ভারতে পুরুষ ও মহিলাদের আত্মহত্যার হারটা কাছাকাছি ছিল। গৃহবধূদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যাটা বেশি। মহিলারা পণপ্রথা, গার্হস্থ্য হিংসার কারণে আত্মহত্যার পথ বেশি বেছে নেয়। অন্যদিকে, পুরুষরা কেরিয়ারের চাপে বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যদিও প্যান্ডেমিকের কারণে সামগ্রিকভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে।
আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রণে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে। শিশু অবস্থা থেকেই মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশোনার চাপ। এ ছাড়া পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। শিক্ষার্থীরা সব কিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বাড়ছে।
আত্মহত্যায় অনেকগুলো আন্তঃসম্পর্কিত এবং অন্তর্নিহিত বিষয় কাজ করে যা ব্যথা এবং হতাশার অনুভূতি সৃষ্টি করে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। নিজেকে হত্যার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন, অস্ত্র, ঔষধ এবং বিষও অনেক সময় এর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
—প্রচারাভিযান বিজ্ঞপ্তি
আত্মহত্যার থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে সবসময়। দরকারে সাহায্য নিতে হবে কাউন্সেলারের। একে অপরের কাছে পৌঁচে গিয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে, হাতে হাত ধরে গড়ে তুলতে হবে আত্মহত্যা-মুক্ত এক দুনিয়া- এমন আশার সুরও শোনা যায় এই বিশেষ দিনটিতে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url